বুধবার, ০৬ অগাস্ট ২০২৫, ১০:২৬ অপরাহ্ন
তৈমূর আলম খন্দকার:
রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক অনুশীলন যথা- জনসভা, বিক্ষোভ, পথসভা, মানববন্ধন, এমনকি পার্টি অফিসের সামনে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকলেও নোংরা গরম পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় পুরুষ বা মহিলা নেতাকর্মীদের। সাদা পোশাকধারীরা নেতাদের ধরে আনে পার্টি অফিসের ভেতর থেকে। কেন এসব করা হচ্ছে? এর উত্তর, পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাজনৈতিক দল কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারবে না। তবে এ আইন সরকারি দলের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং কঠোরভাবে বিরোধী দলের জন্য প্রযোজ্য। স্বীকৃতভাবেই এ দেশে আইন দু’ভাগে প্রয়োগ হয়। সরকারি দলের জন্য আইন একভাবে এবং একই আইন একই বিরোধী দলের জন্য প্রয়োগ হয় ভিন্ন ও কঠোরভাবে। এ দেশে আইন প্রয়োগকারীরা বিরোধী দলের কর্মসূচিতে গ্রেফতার, লাঠিপেটা, গরম পানি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। অন্য দিকে, একই কর্মসূচির জন্য সরকারি দলকে পুলিশ পাহারায় দেয়া হচ্ছে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে।
পুলিশ এটা প্রমাণ করেছে, ন্যায়-অন্যায় যা-ই হোক না কেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ পালন করাই তাদের চাকরির মূল শর্ত। ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করে, নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার যা-ই হোক না কেন, যাদের হাতে ঊর্র্ধ্বতনদের প্রমোশন ও লোভনীয় পদে পোস্টিং; তাদের খুশি রাখাই ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে তারা ডান-বাম চিন্তা করেন না। নৈতিকতা বোধ, আর্দশিক কোনো চিন্তাধারা বা একজন স্বাধীন দেশের নাগরিকের সাথে পরাধীন নাগরিক বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দাস-দাসীদের মতো ব্যবহার করার সময় তাদের মনমানসিকতা ও বিবেক একটুও নাড়া দেয় না, বরং কী করলে প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিং (অর্থাৎ যে পোস্টিংয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়) সেদিকেই জনগণের অর্থে লালিত পুলিশসহ সব রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মকর্তার মনোযোগ বেশি। ম্যাজিস্ট্র্রেটরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তারা বলেন, ওপরের চাপে (ম্যাজিস্ট্রেটদের) বিচারিক সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হন। অথচ সাংধানিকভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তারা ‘স্বাধীন’।
এই মর্মে ১৯৭৫ সালের ২ নম্বর আইনের ২০ ধারা বলে সংবিধান সংশোধন করে অনুচ্ছেদ ১১৬ক সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়। ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়- ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ অথচ ম্যাজিস্ট্র্রেটরা বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে অথবা নিজেরাই দলবাজি করেন। এ বিষয়টি তাদের কর্মকাণ্ডে নিজেরাই প্রমাণ করেছেন। রাজনৈতিক মিথ্যা মামলাগুলোতে এজাহারে বর্ণিত ঘটনার সাথে মামলার সংযুক্ত ধারায় কোনো সঙ্গতি থাকে না। সে বিষয়গুলোও ম্যাজিস্ট্র্রেটরা বিবেচনায় নেন না। ফলে পুলিশের দেয়া ধারাই শিরোধার্য। ঘটনার সাথে সত্যতার লেশমাত্র থাকুক বা না থাকুক ‘আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা’ প্রতিবাদ্য হিসেবে পুলিশ যে ধারা সন্নিবেশিত করে, সে ধারার ওপর ম্যাজিস্ট্র্রেটরা নির্ভর করে বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিচারিক ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্র্রেটদের চেয়ে পুলিশ শক্তিশালী। সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘নি¤œ আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়’। আইন মন্ত্রণালয় অর্থাৎ মন্ত্রী ও সচিবের ইচ্ছার প্রতিফলন।
নবনিযুক্ত পুলিশ প্রধান ড. জাবেদ পাটোয়ারী ২ মার্চ ২০১৮ চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘জনগণের কাছে পুলিশবাহিনীর জবাবদিহিতা, পুলিশ জনগণের দূরত্ব কমে আসবে।’ জাবেদ পাটোয়ারী একটি মূল্যবান কথা বলেছেন, যাতে করে পুলিশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হবে। পুলিশ প্রধানকে তার উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ জানাই। পুলিশের সাথে জনগণের দূরত্ব রয়েছে- এ উপলব্ধি থেকেই তিনি নিশ্চয় এ কথা বলেছেন। তবে তার এ বক্তব্য কি আন্তরিক না লিপ সার্ভিস- এটা জাবেদ পাটোয়ারীর কর্মকাণ্ড থেকেই জনগণ উপলব্ধি করতে পারবে। তিনি যোগদানের পর থেকে দেশব্যাপী প্রতিটি থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সিরিজ মামলা দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো এজাহারে এক আসামির নাম দুইবার, বিদেশে অবস্থারত নেতাকর্মী, এমনকি মৃত ব্যক্তির নামেও এজাহার দেয়া হয়েছে।
এজাহারের ধরন থেকে মনে হয়, একই ফরমেট অনুসরণ করে মামলাগুলো সাজানো হয়েছে। প্রতীয়মান হয়, একই স্থান থেকে এজাহারের নমুনা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। সবগুলো মামলার বিষয়বস্তু ‘খালেদা জিয়ার রায়কে প্রভাবান্বিত করার জন্য নাশকতার পরিকল্পনা।’
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বিএনপিকে প্রতিহত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মারামারিতে একজন খুন হয়, মামলা হয়েছে। পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেফতার করেনি। পটুয়াখালী, চট্টগ্রামে মন্ত্রীদের সামনে নিজেদের মধ্যে মারামারি, টেন্ডারে বিভিন্ন দখলদারিত্ব নিয়ে সরকারি দলের খুনোখুনি পুলিশের চোখে পড়ে না, যেমন- ব্যাংক লোপাটের ঘটনাও দুদক কগনিজেন্স নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সভাপতি যখন লিফলেট (প্রচারপত্র) বিলি করে, তখন পুলিশ প্রটোকল দেয়। অন্য দিকে বিএনপি যখন প্রচারপত্র বিলি করে, তখন পুলিশ বিএনপিকে পেটায় এবং গ্রেফতার করে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন চলাকালে মহাসচিবের হাত থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ বিএনপি কর্মীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। অথচ অ্যাপিলেট ডিভিশনের রায় রয়েছে, সাদা পোশাকে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না। ইয়াবা, চোরাচালান, ধর্ষণসহ বিভিন্ন নৈতিক স্খলনের অভিযোগ তো রয়েছেই, অধিকন্তু বর্তমান মাত্রা যোগ হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করতে নেকড়ে রাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া। এসব করে পুলিশ কার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? এ অবস্থার কারণে জনগণ ভুলেই গিয়েছে, পুলিশ জবাবদিহিতার ঊর্র্ধ্বে।
সম্প্রতি সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন- যেভাবেই হোক না কেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে, নতুবা তাদের রোহিঙ্গা হয়ে যেতে হবে। কোন বিষয়টি মাথায় রেখে খাদ্যমন্ত্রী এ আকাক্সক্ষা করেছেন তা বোধগম্য নয়। তবে এটা পরিষ্কার, জনমত যে সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে তা তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।
কান্না ও মায়াকান্নার তফাৎ মানুষ বোঝে। সমাজে বাহবা পাওয়ার জন্য অনেকেই অনেক কথা বলে, যা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু কার্যকর না হলে বক্তার প্রতি অবিশ্বাস বেড়ে যায়। রাজনৈতিক চর্চা করায় সাংবিধানিক অধিকার যখন আইনি দোহাই দিয়ে পুলিশ ক্ষুণ্ন করে, তখন প্রতীয়মান হয় সরকার সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্য শাসন করছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্য যেখানে সাংবিধানিক অনুমতি লাগবে কেন? সরকারি দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তো পুলিশের অনুমতি লাগে না, তবে বিরোধী দলের জন্য তা লাগবে কেন? এসব প্রশ্ন জনমনে নিয়মিত দোল খাচ্ছে।
লেখক :তৈমূর আলম খন্দকার, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
taimuralamkhandaker@gmail.com